অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক : নিরব দ্যুতি ও অন্তরঙ্গ কাব্য

বিদায়ের অতল আত্মাকে স্পর্শ করা এক অনন্ত অনুবাদ

মুসফিকুর রহমান সুভ | প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২৫ |   

কিছু মানুষের চলে যাওয়াকে মৃত্যু বলা যায় না, কারণ তারা হারিয়ে যান না—শুধু অস্তমিত হন দিগন্তের ওপারে। তারা বেঁচে থাকেন আলো হয়ে, বিশ্বাস হয়ে, হাজারো স্বপ্নের শেকড়ে বেঁধে রাখা এক অবিনশ্বর স্মৃতি হয়ে। তেমনই এক চিরঞ্জীব ব্যক্তিত্বের নাম অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক। আজ এক ব্যথাতুর দিন। এক শূন্যতার দিন। আজকের দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়, এক আবেগের স্রোত, এক অতল বেদনার প্রতিচ্ছবি। ২০১৩ সালের এই দিনে আমরা হারিয়েছি এক স্বপ্নদ্রষ্টাকে, এক আলোছায়ার কারিগরকে—প্রয়াত অধ্যক্ষ মাহফুজুল হককে। তিনি ছিলেন শুধু একজন শিক্ষক নন, ছিলেন শিক্ষার এক দিগন্ত প্রসারী বাতিঘর।

ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়ত অধ্যক্ষ এই মনীষী ছিলেন সহস্র শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ভিত্তি, এক অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর হাত ধরেই অসংখ্য তরুণ পেয়েছে ভবিষ্যতের দিশা, পেয়েছে স্বপ্ন দেখার সাহস। আজও, বহু বছর পরও, তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, ভালোবাসা গেঁথে আছে তাঁর গড়ে তোলা সেই স্বপ্নবীথির প্রতিটি ইট-কাঠে, প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে।

২০১৩ সালের আজকের দিনটি এক ভারাক্রান্ত দিন। ইমপিরিয়াল পরিবারের হৃদয়ে সে দিন গভীর এক শূন্যতার কালো ছায়া নেমে এসেছিল। শুধু মানুষ নয়, সেদিন যেন প্রকৃতিও শোকে নত হয়েছিল। বাতাস স্তব্ধ হয়েছিল, আকাশ তার অশ্রু ঢেলেছিল, গাছের পাতারা কাঁপতে কাঁপতে ঝরে পড়েছিল বেদনাভারে।

কিন্তু মহৎ মানুষেরা কি সত্যিই চলে যান? না, তারা রয়ে যান সময়ের গহীনে, বেঁচে থাকেন তাদের সৃষ্টিতে। মাহফুজুল হক শুধুই একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, ছিলেন শিক্ষার এক মহান কারিগর। তাঁর হাত ধরে অগণিত শিক্ষার্থী নতুন দিগন্তে পা রেখেছে, শিখেছে সত্যের পথে চলতে, আত্মবিশ্বাসের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হতে। তিনি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি আলো ছড়িয়ে গেছেন প্রতিটি অনুজের হৃদয়ে, প্রতিটি শিক্ষার্থীর মননে।

আজও তাঁর সেই আলোকছায়া জ্বলজ্বল করছে, তাঁর আদর্শের বীজ নতুন নতুন প্রাণে অঙ্কুরিত হচ্ছে। তিনি শিখিয়ে গেছেন কেবল পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা নয়, জীবনের শিক্ষা, সাহসের শিক্ষা, স্বপ্ন দেখার ও তা বাস্তবায়নের শিক্ষা। তাঁর অনুপস্থিতি যতটা বাস্তব, তাঁর উপস্থিতিও ততটাই অনুভবযোগ্য—প্রত্যেকটি ছাত্রের অন্তরে, প্রতিটি সফলতার গল্পে, প্রতিটি দীপ্ত অর্জনের গৌরবে। তাঁর বজ্রস্বরের প্রতিধ্বনি যেন সময়ের অতল গহীনে এক প্রাচীন গান, যা শিহরণিত করে আত্মার অন্তঃস্থলে নিঃশব্দ আশার জ্যোৎস্না। তিনি ছিলেন সেই স্বপ্নপথিক, যিনি অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় আলোর শিখা জ্বালিয়ে মানবতার অমর তানপুরের বুনন শুরু করেছিলেন।

তাঁর কর্মধারা, বিদ্যার অমৃতরস, শুধুমাত্র শিক্ষার আলো নয়; মানবতার সেবায়, সংস্কৃতির গন্ধে এবং সত্যের অনবদ্য স্পর্শে আমাদের জীবনের মায়াজাল সৃষ্টির অনন্ত প্রেরণা। তিনি হাতে নিয়েছিলেন আমাদের ভবিষ্যতের রূপ-সীমানা, একেকটি হৃদয়ে প্রতিটি সপ্নের বীজ বপন করে রাখার অমর দায়িত্ব। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল অম্লান। শিক্ষার জগতে, সঙ্গীতের সুরে, সংস্কৃতির প্রেমে এমন এক প্রজ্ঞাপ্রবণ ব্যক্তি ছিলেন তিঁনি, যিনি হিপ-হপের যুগেও রবীন্দ্র সংগীতের মায়ায় মগ্ন হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। পুথিগত বিদ্যার শিখরে পৌঁছাতে, জিপিএ-এর সরলতা থেকে বেড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীর সব শিক্ষার সমাহারে একজন সত্য-জ্ঞানের মুখে পরিণত হওয়ার আদর্শ রচনা করেছেন তিনি।

তাঁর উপস্থাপনায় বিদ্যার ছোঁয়ায় কেবল মেধার বিকাশই নয়, মানব সেবায় নিবেদিতার অমর গাথা রচিত হয়েছে। গ্রাম থেকে মেধাবী গরীব ছেলে-মেয়েদের তুলে এনে নিজের অগাধ চেষ্টায় শিক্ষিত করে, সমাজের দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছেন তিনি। আজকের প্রতিষ্ঠিত, সৃষ্টিশীল সমাজের প্রতিটি অঙ্গে তাঁর ছোঁয়া স্পষ্ট, তাঁর বাণী অমলিন। আমরা যেনো অনেক পেয়েও, তাঁর জন্য কিছুই করতে পারিনি। করার মতো সময় তিনি দেননি, অভিমানে চলে গেছেন অনেক দূরে —তবে তাঁর রেখে যাওয়া কর্ম, তাঁর অবিচল আদর্শ আজো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন—আমাদের মাঝে, আমাদের হয়ে, এক অনন্ত প্রেরণার দ্যুতি হিসেবে।

হারানোর বেদনায়, বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে আজও আমাদের অন্তরে ঝলমল করে তাঁর স্মৃতি; তার কর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিটি স্বপ্নে, প্রতিটি প্রচেষ্টায় তিনি অমর, এক চিরন্তন দীপশিখা হয়ে রয়ে গেছেন।

ঢাকা/এম.এস-২৫/ডেস্ক


মন্তব্য লিখুন :